আমার ভ্রমণ কথন-২ (মারায়ণ তং টু ডামতুয়া)


২০১৭ এর অক্টোবর মাস। আমার প্রিয় ঋতু শরৎকাল। আর এই সিজনে ঘরে বসে থাকা মেনে নেওয়াই যায়না১০জনের একটা টিম  হয়ে গেল আমার সাথে। গন্তব্য মারায়ন তং ভায়া ডামতুয়া ঝর্না। তারিখটা ঠিক মনে নেই। তবে সকাল সকাল রওনা দিলাম। মারায়ন তং বান্দরবন জেলার আলিকদম উপজেলাধীন মিরিঞ্জা রেঞ্জের সবচেয়ে উঁচু চূড়া।উচ্চতা ১৬৪০ ফুট। বান্দরবন এলাকার হলেও এখানে সবচেয়ে দ্রুত 
যাওয়ার উপায় হল আগে চকরিয়া পৌঁছানো। সকাল ১১ টা নাগাদ পৌছুলাম চকরিয়া বাস স্ট্যান্ডে।সেখানে চা সিংগারা খেয়ে লোকাল চাঁদের গাড়িতে 
ঠে পড়লাম .৩০ ঘন্টায় আলিকদম বাস স্ট্যান্ড।যাত্রাপথ টা এতটাই সুন্দর ছিল যে আমি গাড়ির পেছনে দাঁড়ানোর যায়গায় বসে বসেই পুরো পথ পাড়ি দিলাম কিন্তু সেই কষ্ট অনুভব  করলাম না।
আলিকদম বাজার থেকে প্রয়োজনীয় বাজার 
সারলাম গাইড ফারুক ভাই থেকে  টি তাবু নিলাম।সে স্থানীয়। এরপর টমটমে চড়ে রেফার বাজার আবাসিকের রাস্তার মাথায় নামলামএই জায়গাটা মারমা অধ্যুষিত এলাকা।কিছুদুর হেঁটে শিল্বুনিয়া পাড়ায় পৌছুলাম।এখান থেকেই আসল হাইকিং শুরু।



হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টা পার হয়ে গেলো। এরপর মাখাই পাড়া নামে একটি মুরং পাড়া পেলাম। নিচে মারমাদের সাথে চাটগাইয়া ভাষায় কথা বলতে পারলেও এই পাড়ার লোকেরা না বাংলা বুঝে আর না চাটগাইয়া। অনেক কষ্টে এক দাদাকে পেলাম। হ্যাংলা কিন্তু সুঠাম দেহের অধিকারী। তার চেয়েও বেশি কষ্ট হলো এটা বোঝাতে যে আমাদের লাকড়ি দরকার। অবশেষে দাদাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। ৩০০ টাকায় লাকড়িসহ পাহাড়ের চুড়ায় তুলে দিবে। পথিমধ্যে দাদার সাথে হল হাজারো শখের আলাপ। তার অনেক কথা আমরা বুঝলাম না, আমাদের অনেক কথা তিনি বুঝলেন না। হাঁটতে হাঁটতে একসময় চুড়ার ঠিক আগে অবস্থান নিলাম। এখান থেকে হাতের ডানে গেলে একটি ছড়া পাওয়া যায়। সেখান থেকে পরিষ্কার পানি সংগ্রহ করলাম। রাতে যেহেতু আর নামা হচ্ছেনা তাই এগুলাই একমাত্র ভরসা। এরপর আবার হাটা দিলাম। পুরো ঘন্টায় আমরা পৌঁছে গেলাম মারায়ন তং এর চূড়ায়।

চূড়ায় উঠে সেকি এক স্বর্গীয় অনুভূতি। পশ্চিমে মহেশখালী দ্বীপ স্পষ্ট দেখা যায়। পূর্বে রূপবতী মাতামুহুরি নদীর একে বেঁকে চলা। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছিল। একদিকে সূর্যাস্ত অন্যদিকে পূর্ণিমার চাঁদ উঠছে। কি এক অপূর্ব দৃশ্য। নাজমুল অডোমস ক্রিম এনেছিল সেটি সবাই লাগিয়ে নিলাম। মশা তাড়ানোর জন্যে এর চেয়ে ভাল কিছুই নেই। লাকড়ি দিয়ে আগুন জ্বালানো শুরু করে দিলাম। পাশেই ছিল একটি খিয়াং। সেখানে রয়েছে বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। কিভাবে এত উঁচুতে মানুষ আরাধনা করতে আসে এটাই ভেবে কুল পাইনা। এখানে এর আগে যারাই এসেছে তারা কিন্তু এই এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখেছে। ব্যাপারটা দেখে খুব ভাল লাগলো। আগুন জ্বালানো হয়ে গেছে। তাবু গুলো টাঙ্গিয়ে ফেললাম। পূর্ণিমার আকাশে দূর থেকে অসংখ্য ফানুশের দেখা পেলাম। গান বাজনা আনন্দ ফুর্তি করতে করতেই রাতের ১২ টা বেজে গেলো। ক্ষিদা মিটালাম বাজার থেকে কেনা জন প্রতি পিচ বনের সাথে কন্ডেন্স মিল্ক মিশিয়ে আর তার সাথে হালি করে কলা। খেয়ে দেয়ে ময়লা সব প্যাক করে রেখে দিলাম। এরপর তাবুর ফাঁকে আকাশের চাঁদের দিকে তাকাতে তাকাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।



রাতের টা। হটাৎ পিঠ ভেজা ভেজা মনে হল। সাথে প্রচণ্ড বাতাস। বুঝলাম বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সে এক মুষলধারে বৃষ্টি। এর সাথেই যোগ দিল বজ্রপাত। তাবু উড়ে যাচ্ছিল। দ্রুত সবাই বড় একটা প্যাকেট জড়িয়ে মন্দির টিতে আশ্রয় নিলাম। চোখের সামনেই একটা পাহাড়ের চূড়ায় বজ্রপাত হল। বুঝে ফেললাম যে এই পাহারেও পড়বে। অথচ সেই দাদা যাওয়ার সময় বলেছিল এখানে কখনও বজ্রপাত হয়না। মন্দিরের উপরে আরো টিন। সবাই মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলাম আজকের রাত আমাদের শেষ রাত। সাব্বির ভাই, আমি আর ইন্তি বলেছিলাম যে বেঁচে ফিরলে শোকরানা নামাজ পড়ব। সবার সে কি কান্নাকাটি। এই ভয়াল অবস্থা চলতে লাগলো ফজরের আগ পর্যন্ত। বৌদ্ধ মন্দিরে বসেই আল্লাহ্‌ খোদা সব ডাকলাম। পৃথিবী কতই না বিচিত্র। এরপর ভোর হল। বৃষ্টি বজ্রপাত দুটোই থামল। ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হল। আর এই স্বর্গীয় দৃশ্য চোখে পড়ল।

এখানে তউসিফের একটা ঘটনা বিশেষ কারনে বলা যাচ্ছেনা। রোদ উঠার সাথে সাথেই সব গুছিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। আসার সময় সেই দাদার বাসায় কিছু পানি খেলাম। সাথে বেশ কিছু পাহাড়ি কমলা কিনলাম। একদাম টাকা করে। সেগুলো খেতেই খেতেই রেফার বাজারে চলে এলাম। এখানে এসেই সাব্বির ভাই তার নামাজ টা পড়ে নিল। আমরাও খেয়ে দেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।



কাল রাতের ঘটনার পর বেশিরভাগই আর ডামতুয়া যাওয়ার পক্ষে না। তবে নাজমুল, তউসিফ এর অনুপ্রেরণায় শেষ মেশ সবাইকে রাজি করিয়ে ফেললাম। আলিকদম বাজার এসে ফারুক ভাইয়ের সাহায্যে একটা গাড়ি রিজার্ভ করলাম। এই গাড়ি পানবাজার দিয়ে ঢুকে আলিকদম থানচি সড়ক হয়ে আমাদের পৌঁছে দিল ১৭ কিলোর আদুপাড়া নামক স্থানে। পথে থিংকু পাড়া আর্মি ক্যাম্পেও রিপোরটিং করতে হল। আদুপাড়া থেকে একজন গাইড নিলাম। নাম পালাও ত্রিপুরা। তিন ঘন্টার এক দুঃসাধ্য ট্রেক করে পৌঁছুলাম ডামতুয়া ঝর্ণায়। যাত্রাপথে কিছুক্ষণ পর পরই জিজ্ঞেস করতে হচ্ছিল আর কতদূর। আর কিছুদুর পর পর দু পাহাড়ের মাঝখানে কাঠের গুড়ি দিয়ে পার হতে হচ্ছিল। কি যে বিপজ্জনক। পড়লে লাশটাও পাওয়া যাবেনা। যাই হোক। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল। তাই ঝর্ণায় খুব বেশিক্ষণ থাকা হলনা। যতটুকুই ছিলাম শুধু আনন্দই করেছি। এরপর ফিরতি পথ ধরলাম।



আদুপাড়া আসতে আসতেই রাত হয়ে গেল। তার উপর সেদিন বাইক এক্সিডেন্টে একটা ছেলে মারা যাওয়ায় গাড়ি চলাচল অনেক ক্ষন বন্ধ ছিল। অবশেষে রাত টা বাজে আর্মি ক্যাম্পে অনেক কাকুতি মিনতি করে পার পেলাম। টায় শেষ জীপে চড়ে আলিকদম বাজার থেকে চকরিয়ার পথ ধরলাম। মাঝের সময়টা দৌড়ের উপর ছিলাম। পাহাড়ি রাস্তায় এত রাতে গাড়িতে চরছি। এত সাহস কোথা থেকে আসল বুঝলাম না। পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতেই ১০.৩০ টা বাজে পৌঁছুলাম চকরিয়া। সেখান থেকে শহরে ফেরা মানে আজকে আর বাসায় ঢুকতে পারবনা। এখন উপায়?
হ্যা, উপায় একটা হল। এই যাত্রায় আরমান আমাদের বাঁচালো। তার বাড়ি চকরিয়াতেই। নামজাদা ফ্যামিলির ছেলে। বাসায় গিয়ে সেই কি খাতিরদারি। ১০ পদের সবজি আর পদের মাছ খেলাম। তাই তাদের প্রজেক্টের। কি আনন্দ রে বাবা। সেদিনের রাত টা খুব আরামে গেল। পরদিন সকালে এতটাই চিল মুডে সবাই যে তাৎক্ষনিক কক্সবাজারের প্ল্যান হল। বাহ, এক ট্যুরে আর কত কি যে করবে তারা। আরমানের বাসার সবাইকে বিদায় দিয়ে টমটমে করে চলে গেলাম কক্সবাজার। সেখানে গিয়ে আমি আর ইন্তি আমাদের শোকরানা আর কিছু কাজা নামাজ পড়লাম। বাকিরা কক্সবাজার তুলে নিয়ে আসতেছে। আমরাও শেষদিকে কিছু আনন্দ ফুর্তি করলাম। এরপর বিকালের বাসে শহরের পথ ধরলাম। ব্যস্ততার শহর। নিরানন্দের শহর। বাসে ঘুমের মধ্যেও মনে হচ্ছে আমি এখন মারায়ন তং এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি। আবার মনে হল ডামতুয়ায় গা এলিয়ে গোসল করছি।

Comments

Popular posts from this blog

আমার ভ্রমণ কথন- ৪ ( থানচির পথে প্রান্তরে)

আমার ভ্রমণ কথন- ১ (লেক পাহাড়ের রুমা)