আমার ভ্রমণ কথন- ৪ ( থানচির পথে প্রান্তরে)
সাল ২০১৯,
ফেব্রুয়ারি মাস।
কড়া শীতকাল চলছে।
এর মাঝে একটা অল্প কদিনের ছুটি পেয়ে গেলাম।
ভাবলাম কোথাও ঘুরে আসি বন্ধুদের নিয়ে।
যেই ভাবা সেই কাজ।
সঙ্গী সাথি বলতে আছে ইকবাল,
নকিব,
আরিফ,
ইন্তি,
আমির,
অনিন্দ্য আর দুই মহিলা সদস্য প্রিয়াংকা আর তাসরিন।
সাথে প্রিয়ার ছোট ভাই প্রিয়ম।
গন্তব্য এবার থানছি।
বান্ধবীদের ওয়াদা করলাম যে সবসময় ছেলেদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়।
এবার তাদের নিয়েই যাবো ইনশা আল্লাহ্। গাইড ঝুন্টু দাদার সাথে কথা বলে একটা জীপ ভাড়া করে রাখলাম আগের দিন।
সকাল সকাল বান্দরবন বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছুলাম লোকাল বাসে চড়েই।
সেখানে ড্রাইভার রনি দাদা আগে থেকেই রেডি।
হাল্কা নাস্তা পানি খেয়ে দেয়ে কিছু কিনেও নিলাম।
যাত্রা এবার অনেক লম্বা।
বাসে থানচি যাওয়া যায়।
কিন্তু এই বিশাল ৭৯.৩ কি,মি, এর পথ যেখানে জীপে যেতে ৩/৪ ঘণ্টা লাগে সেখানে বাসে যাওয়াটা কোনভাবেই সমীচীন না।
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
যাই হোক।
১১ টায় রওনা হলাম।
পথিমধ্যে সেই বান্দরবনের পাহাড়ের সৌন্দর্যে প্রতিবারের মত হারিয়ে গেলাম।
বেশিরভাগ সময় আমার মাথা মাহেন্দ্রের উপরেই ছিল।
দূরের মেঘ গুলো পাহাড়ের উপর ছায়া দিচ্ছে।
আর সাথে ঠাণ্ডা বাতাস।
আবার বাতাসের মাঝে শীতের দুপুরে রোদের ঝলক। যেতে যেতে ৩ টা বাজল থানচি বাজার পৌঁছুতে।
এখানে দ্রুত পুলিশ ক্যাম্পে রিপোরটিং সারলাম।
তারপর একটা ফর্ম ফিল আপ করে হাঁটা দিলাম থানচি বোট ঘাটের দিকে।
এর আগে ড্রাইভারের ভাড়া কিছু দিয়ে দিলাম।
উনার সাথে আবার দেখা হবে দুই দিন পর।
বোট ঘাটে এসে ভাড়ায় লাইফ জ্যাকেট নিলাম সবার জন্যে।
সেইফটি ফার্স্ট।
এখানে গাইডের সাহায্যে ভাড়া করে রাখা দুইটা বোটে সবাই উঠে পড়লাম।
শুরু হল সাঙ্গু ভ্রমণ।
সাঙ্গু নদী দিয়ে তিন্দুর রেমাক্রি বাজার যাবো।
স্রোতের বিপরীতে ২/২.৩০ ঘণ্টার পথ।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দেখা মিলল ঐতিহাসিক বড় পাথরের।
একে রাজা পাথর ও বলা হয়।
স্থানীয়রা এর পূজা করে থাকে।
তাছাড়া দর্শনার্থী রাও একে সম্মান দেখিয়ে চলে।
এছাড়াও এখানে দেখা মিলল রানী পাথর,
কলসি পাথর,
কুলা পাথর সহ আরও নানা নাম দেওয়া পাথর সমগ্রের।
একেকটি পাথর যেন একেকটি ইতিহাস।
এই বড় পাথর কে রাজা পাথর বলার একটা কারণ হচ্ছে বর্ষায় যখন এখানে সমস্ত পাথর ডুবে যায় তখনও সমহিমায় এটি দাঁড়িয়ে থাকে।
রেমাক্রি বাজারের আগে ছোট একটা গ্রাম পড়বে।
এখানে একটু যাত্রা বিরতি নিলাম।
সারাদিন যা খেয়েছি পরিমিত ছিলনা।
তাই সবাই একটা করে ডিম,
কলা,
বিস্কিট,
চানাচুর খেয়ে উদরপূর্তি করলাম।
সেই সাথে ছিল গরম গরম চা।
তখন ইতিমধ্যেই পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে।
শীতের সন্ধ্যা বলে কথা।
ছবিতে বন্ধু ইন্তি চা পান করছেন।
এরপর রেমাক্রির উদ্দ্যেশ্যে আবার যাত্রা শুরু।
কিন্তু নদীতে পানি কমে যাওয়ায় কিছুদূর পর পর নৌকা আটকে যাচ্ছে।
নেমে নেমে ঠেলে ঠেলে সামনে এগুতে হচ্ছে।
একে তো সব পাথর তার উপর এতটাই পিচ্ছিল যে ঠিকমতো এই পানিতে দাঁড়িয়ে থাকাও অনেক মুশকিল।
সেই সাথে সাপ বিচ্ছুর ভয় তো আছেই।
অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে শেষ মেশ পৌঁছে গেলাম রেমাক্রি বাজার।
অন্ধকার রাতে পাহাড়ের চুড়ায় রঙ বেরঙের আলো দেখে যে শান্তি টা তখন পেলাম তা ভাষায় প্রকাশ যোগ্য না।
অনেক দরকষাকষি করে আমরা ছেলে ৭ জনের জন্যে একটা বড় ঝুম ঘর আর মেয়ে দুইজনের জন্যে শিল গিরি রিসোর্ট এ একটা রুম ভাড়া নিলাম।
গাইড দাদা আলাদা থাকবেন বোটের মাঝিদের সাথে।
যদিও আমাদের নিয়ে ব্যাক করা না পর্যন্ত উনাদের যাবতীয় আহার খরচ আমাদের।
এটা কিন্তু নিয়ম।
যাই হোক।
অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় ভাত খেয়ে ফেলতে হবে।
তাই হোটেলে যা পেলাম তাই খেলাম।
এখানে থাকা খরচ খাওয়া খরচ সবই ১৫০ টাকার ফিগার।
ভাতের আইটেমে ছিল ভাত,
ডাল,
আলু ভর্তা,
মুরগি।
খেয়ে দেয়ে সবাই যখন টাইট তখন আরিফ আর ইন্তির মাথায় আসলো ক্যাম্প ফায়ার করব।
যেই কথা সেই কাজ।
ক্যাম্প ফায়ারের মধ্যে গাইড দাদাকে নিয়ে সবাই গোল টেবিল বৈঠক বসালাম আর শুরু হল হরেক রকমের ভৌতিক গল্পের।
চারদিকে সে যে কি ঠাণ্ডা।
মোবাইলে কোন নেটওয়ার্ক নেই এই জায়গায়।
সেনাবাহিনীর নির্দেশে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে এখানে এই সুবিধা নেই।
কারণ খুব কাছেই বার্মার সীমান্ত।
এখানে আছে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
তাই সার্বিক বিবেচনায় এই এলাকা এখনও মোবাইল নেটওয়ার্ক এর আওতা বহির্ভূত।
ক্যাম্পফায়ারের মাঝে অমাবশ্যার এই রাতে স্টার গেজিং করতে করতেই অর্ধেক শেষ।
অবশেষে সবাই যার যার রুমে চলে গেলাম ঘুমোতে।
কাল অনেক কিছু আছে।
পরদিন সকালে কুয়াশায় চারদিক সাদা।
ভেবেছিলাম ৬ টায় রওনা দিব।
সেই রওনা ৮ টায় ও হলনা।
হাত-
মুখ ধুতে গিয়ে বুঝতে পারলাম শীতের দেশে জন্ম না হওয়াটা কত বড় রহমত আমার জন্যে।
সকালে ভুনা খিচুরি অর্ডার দিলাম।
খিচুড়ি খেতে খেতে সামনের রেমাক্রি ঝর্না দেখলাম।
এটা তে এখনও গোসল করা হলনা।
এই জায়গায় এক দিক চলে গেছে নাফাখুমের দিকে।
আরেকদিক চলে গেছে সাঙ্গু নদী হয়ে বড় মদকের দিকে।
পাহাড়ি মোরগের ভুনা ঝাল খিচুড়ি খেয়ে হাঁটা ধরলাম এবার নাফাখুমের পথে।
এই যাত্রায় একজন নতুন গাইড নিলাম।
২/২.৩০ ঘণ্টার হাঁটার পথ নাফাখুম।
সূর্য তখনও উঠেনি।
কিন্তু আমরা হেঁটেই চলেছি।
ঘণ্টা খানেক পর একটা দোকানে আবার কিছু ডিম কলা খাওয়া হল।
সাথে বিপুল পরিমাণ পানি।
দোকানে দেখলাম কাঠ বেড়ালির মাংস।
স্থানীয়রা এটা অনেক টা চিকেন ফ্রাই এর মত করে খায়।
ছবি এখানে আর দিলাম না।
এরপর কিছু ছোট খাটো পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে চলতে চলতে চলে এলাম নাফাখুম।
অদ্ভুত সুন্দর একটি খুম।
স্বচ্ছ পানির অবিরাম ধারা এই শীতকালেও অব্যাহত আছে।
নাফাখুমের পিছে একটি পাড়া আছে।
তার পিছেই এই পাহাড়।
এদিকে এসে দেখি আমির লাফ দিল খুমে।
সাতার না জানায় এই আনন্দ কপালে জুঠলনা।
বাকিরাও আমার মত এদিক সেদিক ঘুরে পানিতে পা ভিজিয়ে ফিরতি পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিল।
কিন্তু আমাদের আমির সাহেব যেন পানি থেকে উঠবেন ই না।
অনেক বলার পর অবশেষে তিনি উঠলেন।
একরাশ স্মৃতি নিয়ে বিদায় দিলাম নাফাখুম কে।
দুপুরের আগেই চলে এলাম আবার রেমাক্রি বাজারে।
এবার ঝর্ণায় গোসল করবই।
দুপুরের লাঞ্ছ সেরেই লাইফ জ্যাকেট নিয়ে নেমে পড়লাম পানিতে।
ঝর্ণার পানি গরম কিন্তু সাঙ্গুর পানি ঠাণ্ডা।
এক অন্যরকম অনুভূতি এই পানিতে গোসল করা।
গভীরতা কম হওয়ায় এখানে সাতার জানার ও প্রয়োজন নেই।
তার উপর লাইফ জ্যাকেট তো আছেই।
সেই জ্যাকেটের উপর ভর দিয়ে হাতে হাত বেঁধে সবাই স্রোতের টানে শুয়ে গেলাম।
আর মনুষ্য নৌকার মত স্রোতের টানে চলতে লাগলাম।কিছুদূর গিয়ে আবার এগিয়ে এসে আগের মত গা এলিয়ে দিলাম আর স্রোতের টানে সামনে চলে যেতে লাগলাম।
এভাবে ঘণ্টা খানেক রেমাক্রি ঝর্ণায় কাটিয়ে সবাই উঠে এলাম।
সব গুছিয়ে নিয়ে হোটেল থেকে চেক আউট করে যার যার বোটে আগের মত চড়ে বসলাম।
এবার কিন্তু স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছি।
তাই ঘণ্টা খানেকের মধ্যে থানচি বাজার পৌঁছে গেলাম।
পথিমধ্যে সেই রাজা পাথর,
রানী পাথরদের বিদায় দিয়ে আসলাম।
থানচি বাজার পৌঁছে এক বিজিবি সদস্যের নিকট শুনলাম বর্ষায় লাইফ জ্যাকেট ছাড়া যাওয়ায় নৌকা উল্টে বুয়েটের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা।
সেই ভয়াবহ কাহিনী এখানে আর নাই বলি।
লাইফ জ্যাকেট ফেরত দিয়ে আর বোট ড্রাইভার দের দেনা পাওনা চুকিয়ে দিলাম।
এরপর সন্ধ্যার নাস্তা পানি খেয়ে আসলাম থানচি কুটিরে থাকার জন্যে।
এই এলাকায় কম দামের রিসোর্ট হিসেবে এটি বেশ সমাদৃত।
পাহাড়ের উপরে বেশ সাজানো গোছানো একটি রিসোর্ট।
রাতে বার বি কিউ পার্টি হল।
বাজার সাজারের কাজ আমাদের গাইড ঝুন্টু দাদাই সারল।
আমরাও কিছুটা সাহায্য করলাম।
সবাই মিলে খেয়ে দেয়ে রাতে কটেজে উঠলাম।
রুম গুলো ও বেশ সাজানো গুছানো।
এখানে এসেই নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল।
তাই রেমাক্রিতে সবাই মিলে যে আড্ডা গল্প গুজব হয়েছিল তার কিছুই এখানে হলনা।
আসলেই প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আমাদেরকে কাছে থেকেও দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
যাই হোক,
থানচিতে দ্বিতীয় রাত এভাবেই কাটল।
পরদিন সকালে আশপাশে হালকা ঘুরাঘুরি হল।
দূরের চিম্বুক পাহাড়ের রেইঞ্জ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরপর থানচি ব্রিজের উপর হল ফটোসেশন।
এখান থেকে শুকিয়ে যাওয়া সাঙ্গুকে দেখা যাচ্ছে। কত স্বপ্ন, স্মৃতি এই নদীকে ঘিরে।
এরপর সব গুছিয়ে সেই ভাড়া করা মাহেন্দ্র তে উঠে পড়লাম।
এখান থেকে বিজিবির অবকাশ হোটেল টা খুব সুন্দর দেখায়। থানচি আর গাইড ঝুন্টু দাদাকে
বিদায় দিয়ে রওনা দিলাম বান্দরবনের পথে। মাঝখানে চলতি পথে মিলন ছড়িতে নেমে একটি
ঐতিহাসিক নাচের ভিডিও বানালাম যা এখানে দেওয়ার উপযুক্ত নয়। মিলন ছড়ি থেকে সাঙ্গু
কে অন্যরকম সুন্দর লাগে। বিকালের মধ্যেই আমরা বান্দরবন বাস স্ট্যান্ড চলে এলাম।
এখান থেকে ৫.৩০ টার বাসে চড়ে রওনা দিলাম শহরের দিকে। প্রকৃতির মায়া ছেড়ে আবার সেই
যান্ত্রিক জীবনে। তারপরেও দিন শেষে এমন স্মৃতি পাওয়াটাই হয়ত এই ট্যুর গুলোর সবচেয়ে
বড় অর্জন।
Comments
Post a Comment