আমার ভ্রমণ কথন-৩ (আলীর গুহাসমগ্র)
এপ্রিল মাস, ২০১৬ সাল।
কিসের জানি একটা ছুটি পেয়েছিলাম ঠিক মনে করতে পারছিনা।
আমরা আবার উড়নচণ্ডী মানুষজন।
পরিক্ষার আগে দুইটা দিন বেশি পেলেও কোন একটা জায়গা ঘুরে আসতে হবে।
তো এইবারের ভ্রমণে ছিলাম আমরা ৯ জন।
এর মধ্যে আমাদের কুমিল্লার মুরাদ সাহেব যিনি কিনা এ যাবত আমাদের সাথে কোন শর্ট ট্যুরে থাকেন না উনিও জানতে পারলেন যে এটা একটু লং ট্যুর তাই উনাকে এই যাত্রায় পাওয়া গেল।
চলে এলাম আমাদের সেই পুরনো আস্তানায়।
মানে নতুন ব্রিজ।
এদিক দিয়েই বর্তমানে বান্দরবন,
কক্সবাজার যায়।
যদিও যাচ্ছিলাম বান্দরবন কিন্তু উঠে গেলাম কক্সবাজারের গাড়িতে।
কেন সেটা পরে বলছি।
গান গাইতে গাইতে আর কমেডি করতে করতে যাচ্ছিলাম চকরিয়ার দিকে।
সম্ভবত বাসের যাত্রীগণ আমাদের দেখে বোঝার উপায় ছিলনা যে এরা আগেও বান্দরবন গিয়েছে। যাই হোক।
২.৩০ ঘণ্টায় চলে আসলাম চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড।
এখানে এসে চা চপ সিংগারা খেয়ে পেট পূজা সেরে নিলাম।
এখন বাস স্ট্যান্ড থেকে যাবো বান্দরবনের আলিকদম।
আসলে আলিকদম বান্দরবনে পড়লেও মূল বান্দরবন দিয়ে যাওয়ার চাইতে কক্সবাজারের চকরিয়া দিয়ে যাওয়া সহজ ও কম সময় সাপেক্ষ।
এখান থেকে একটা জীপ,
লোকাল ভাষায় শর্ট বডি ভাড়া করলাম।
ঠিক ভাড়া না।
আমরা লোকাল গাড়িতে লোকালই যেতে পছন্দ করি।
তো এই শর্ট বডিতে উঠে মনে হচ্ছিল আসলেই আজকে শরীর শর্ট হয়ে যাবে।
তারপরেও গাড়ি যখন লামা হয়ে আলিকদমের দিকে যাচ্ছিল তখন চারপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখে সব ভুলে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু পথিমধ্যে টের পেলাম যে গাড়ির ছাদে এক ব্যবসায়ি সুপারি নিয়ে যাচ্ছিল।
তার সেই সুপারির ভেজা পানি গায়ে পড়ছিল।
সেই গন্ধ আজও নাক থেকে যাইনি।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে চলে আসলাম আলিকদম বাস স্ট্যান্ড।
শুরু হল এডভেঞ্চারের।
বাস স্ট্যান্ড যখন পৌঁছুলাম তখন দুপুর দুইটা।
ভাত না খেয়ে হাল্কা নাস্তা পানি করে নিলাম।
কারণ প্ল্যান ছিল আজকেই আলিকদমের আলীর গুহা ঘুরে আমরা শহরে ব্যাক দিব।
তাই খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে ছিলাম।
তার উপর এখানে নতুন এক গুহার সন্ধান পেলাম টিংকু চৌধুরীর ভিডিও তে।
তো সেখান থেকে একটা লোকাল টমটমে চড়ে চলে এলাম টোয়াইন খালে।
খুব বেশি দূর না এই জায়গাটা।
মিনিট ১৫ লাগে।
এটা আসলে মাতামুহুরি নদীর অংশ বিশেষ।
এখান থেকে মানুষজনের সহায়তায় একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম আলীর গুহার দিকে।
সারি সারি পাহাড় গুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল।
আর বিশাল ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে টোয়াইন খাল টা যে কি অপরূপ লাগছিল। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা আবিষ্কার করলাম এই জায়গাটা।
রাস্তা ছিল ২ মিনিটের কিন্তু বৃষ্টি পড়ায় এই জায়গাটা বেশ গভীর হয়ে ছিল।
তাই দুই পা আর দুই হাতে ঠেশ দিয়ে বহু কষ্টে সে পুলসিরাত পার হলাম।
সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি এক জায়গায় দুই টা বাঁক।
আমরা ডান পাশের বাঁক ধরে এগিয়ে গেলাম।
আর চলে এলাম প্রথম গুহার নিচে।
এখানে সেনাবাহিনীর দেওয়া এই পুরনো সিঁড়ির ভরসায় একে একে উপরে উঠলাম। কি ভয়ানক এই সিঁড়ি। না উঠলে আমার কথার মর্ম বোঝা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।
উপরে উঠে প্রথম দিকে বেশ আনন্দে ছিলাম,
কিন্তু যেই বাদুড়ের সন্ধানে এখানে এলাম সেটি আর দেখা হলনা।
মানুষের করাল গ্রাসে সব শেষ।
চারদিকে দেয়ালিকায় ভর্তি।
কি আনন্দ পায় তারা আমি বুঝিনা।
একটা জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারাটাই যেন তাদের অর্জন।
সেই সাথে প্লাস্টিকের জঞ্জাল এই রকম একটা গুহাকেও মুক্তি দিলনা।
তার উপর এই গুহা একমুখী।
হয়ত কখনও এর আরেক মুখ ছিল যেটি পাহাড়ি ধসে অনেক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ ফটো সেশন করে নেমে পড়লাম।
এবার ফিরতি পথের যেই জায়গাটিতে বলেছিলাম একটি বাঁক ছিল সেটিতে এসে বাম পাশে পথটি ধরলাম।
যেই পথে এখনও অমানুষদের তেমন পদচিহ্ন পড়েনি।
কিছুদুর যেতেই এই কঠিন জায়গাটি পড়ল। দড়ির সাহায্যে একে একে উঠলাম। এই ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করল আমাদের মিসবাহ। সাথে ইকবাল ও ছিল।
এরপর যেতে যেতে কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলাম একটা ছোট্ট সুরঙ্গ।কিছু বুঝে উঠার আগেই একে একে সবাই লাইট জ্বালিয়ে ঢুকে পড়ল।সবাই একটা দড়িতে বাঁধা ছিলাম। ভেতরে ঢুকেই দেখি এ এক বিশাল গুহা। সত্যিকার বাদুড় গুহার।বাদুড়ের কিচির মিচির আওয়াজ শুনে আমরা নিরবে নিস্তব্দে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
এখানে কিছুদুর পর পরই এরকম অসংখ্য কুঠরি।
অল্প লাইট মারলেই বেরিয়ে আসে বাদুড়ের ঝাক।
আমার ক্যামেরার হাতে ধরা পড়ল এই বাদুড়।
এগুলো আসলে ফ্রুট ব্যাট।
এরা মানুষের কোন ক্ষতি করেনা।
কিন্তু মানুষ না জেনে না বুঝেই এদের মেরে ফেলে।
গুহার কিছু জায়গা অনেক বড় আবার কিছু জায়গা এরকম। সেনাবাহিনীর মত ক্রলিং করে করে পার হতে হয়। গুহার ভেতর ভীষণ গা ছমছমে অন্ধকার। খুব ঠাণ্ডা। তবে যে বিষয়টা সবচেয়ে কষ্ট দিবে সেটি হচ্ছে ইয়া বড় বড় মশা। এদের কামড়ে সুন্দর পরিবেশ টা বেশিক্ষণ উপভোগ করা গেলনা।
প্রায় আধা কিলো লম্বা এই গুহা।
মিনিট ১৫ তে আমরা চলে এলাম এর শেষ প্রান্তে। এই দিকের মুখ টি কিন্তু বেশ বড়।
এরপর সবাই মিলে আমাদের ভ্রমণ টিম অভিযাত্রিক কে উৎসর্গ করে একটি পোজ দিলাম। বরাবরের মতই আমি বাদ। কারণ এই ছবি গুলো আমারই তোলা।
দীর্ঘক্ষণ গুহার ভেতরে গবেষণা শেষ করেই আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। তখন অলরেডি বিকাল ৫ টা। ৬ টায় এখান থেকে শেষ গাড়ি চকরিয়ার উদ্দ্যেশে যেত তখন। এখন শুনছি রাত ৮ টা বাজেও আলিকদম থেকে আসা যায়। যাই হোক, দ্রুত পা চালিয়ে ৬ টার আগেই আলিকদম বাজার চলে এলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম ৬.৩০ টার একটা জীপ আছে। সেটিতেই ভাড়া নিলাম। টোয়াইন খালে হাত মুখ ধুইতে ধুইতে কিছু সময় নষ্ট হয়েছিল। তাই ৬ টার জীপ ধরতে পারিনাই। যাই হোক। ৬.৩০ টার জীপ ছাড়তে ছাড়তে ৭ টা। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। আকাশের চাঁদের আলোতে দুরের পাহাড় গুলো কি যে সুন্দর লাগছিল। জীপ চকরিয়া বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছুল রাত ৯ টায়। এখান থেকে বাসে উঠলেও আজ শহরে রাত ১২ টার আগে পৌঁছুনও যাবেনা। তার উপর ক্যাম্পাসের মানুষজন ছিল তিনজন। দিনাজপুরের সৌরভ, কুমিল্লার মুরাদ আর সিলেটের সুজন। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল মিসবাহের বোনের বাড়িতে উঠবো আজ রাত।
মিসবাহ তার বোনের সাথে কথা বলে রাখল।
ওর বোনের বাসা লোহা গাড়ার আমিরাবাদে।
হাল্কা নাস্তা পানি খেয়ে চলে এলাম আমিরাবাদ।
সেখান থেকে পায়ে হেটেই রওনা দিলাম তার বোনের বাসায়।
সবাই একসাথে।
এক তালে।
বাসায় পৌঁছে জংগল থেকে আসা মানুষজনের খাতিরে কোন ঘাটতি ছিলনা।
গোসল পর্ব সেরে শুরু হল খাওয়া পর্ব।
কি যে খাওয়া সেখানে। মানে জেল ফেরত আসামি কে আজ রেস্টুরেন্টে খেতে দিয়েছে।
৫ পদের মাছের পাশাপাশি ছিল মুরগি,
গরু,
ডিম আর নানা পদের সবজি।
সেই খাবার খেয়ে গল্প করতে করতেই যেন রাত কেটে যাচ্ছে।
আর হাল্কা হাল্কা বৃষ্টি পড়ছে।
কি পারফেক্ট টাইমিং।
তারপর কারটেসি বুঝে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ফিরতে হবে আবার আপন ভুবনে।
Comments
Post a Comment